ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

‘দ্যা হিন্দু’র দৃষ্টিতে ভারতের রাজনীতির কাছে জিম্মি বাংলাদেশ

hinduঅনলাইন ডেস্ক :::

বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর এবং অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা এবং বিদ্যুৎখাত থেকে পারমাণবিক জ্বালানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার সংক্রান্ত ৩৬টি চুক্তি নির্দেশ করছে যে, গত আট বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে। যদিও স্থগিত থাকা তিস্তাচুক্তি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে টানাপড়েনে রেখেছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সাধারণ জনগণের জীবন-জীবিকায় তিস্তার পানি প্রভাব ফেলে থাকে। এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, দিল্লির সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে তিস্তা একটি কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তার ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে ৫৪টি নদীতেই হিস্যার দাবিদার। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার নদী ব্যবস্থার বাইরে দুদেশের মধ্যে বহমান নদীসমূহের মধ্যে তিস্তা চতুর্থ বৃহত্তম। ১৯৮৩ সালে একটি অ্যাডহক পানিবণ্টন চুক্তির আওতায় ভারতকে ৩৯ শতাংশ, বাংলাদেশকে ৩৬ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ২৫ ভাগ পানি পরবর্তীতে বণ্টনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তিস্তা নদীর সমতলের এলাকা বাংলাদেশে ২ হাজার ৭শ’ ৫০ বর্গ কি.মি. এলাকায় বিস্তৃত। এখানে প্রায় এক কোটি মানুষের বাস। প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশের পাঁচটি জেলার এক লাখ হেক্টর জমি শুকনো মৌসুমে প্রচণ্ড পানি সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। নদীর উপর সরাসরি জীবন-জীবিকার নির্ভরতা ছাড়াও নদীর পানি প্রবাহের উপর ১৪ ভাগ শস্য উৎপাদনের প্রভাব ফেলে তিস্তা। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের বাঁচা-মরা তিস্তা নদীর পানির উপর নির্ভরশীল। সুতরাং তিস্তা নদীর পানির সমান বণ্টনের জন্য একটি ট্রিটি থাকবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আর নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এটা একটা ন্যায্য দাবি।
কত কাছে কত দূরে
২০১১ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরকালে ১৫ বছরের একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনার আওতায় ভারতের পাওয়ার কথা ৪২.৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশ পাবে ৩৭.৫ শতাংশ। অবশ্যই এটা শুকনো মৌসুমের পানি ভাগাভাগির হিসাব। ভবিষ্যতের জন্য যথাযথ তথ্য সংগ্রহে একটি যৌথ হাইড্রোলজিক্যাল পর্যবেক্ষণ স্টেশন স্থাপনের কথাও তাতে ছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ড. মনমোহন সিং-এর সঙ্গে ঢাকা যেতে বেঁকে বসেন। তিনি তখন তিস্তা চুক্তিতে বৃহত্তর পানির হিস্যা দেয়ার বিষয়ে বাদ সেধেছিলেন।
এরপরে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কারণ ঢাকা সফর থেকে ফিরে তিনি বলেছিলেন, ‘তিস্তা বিষয়ে আমার উপর আস্থা রাখুন। আমি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবো।’ তার পুনঃআশ্বাস শুনতে বাংলাদেশকে পানির হিস্যা দেয়ার বিষয়ে তিনি তার তড়পানো নীতি বজায় রাখেন। পুনরায় ২০১৫ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে তিনি অংশ নেন। এবং তখন উভয়পক্ষে ইতিবাচক আশাবাদের মনোভাব সৃষ্টি হয়। মোদি সরকার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মিজ ব্যানার্জী তাতে রাজি হননি। সে কারণে মি. মোদির জবানিতে ‘নদীসমূহ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের পথে অসন্তোষের উৎস নয়, বরং তা সম্প্রীতির বন্ধন কাজে লাগানো উচিত’ উচ্চারিত হলেও সেই চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। সাধারণ ধারণা হয়েছে, ২০১৬ সালের এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিস্তা চুক্তি সই সম্ভব ছিল না। কিন্তু একাদিক্রমে দ্বিতীয় দফা সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করার পরেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দিল্লিতে এক মুখোমুখি বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, ‘আপনার সমস্যা পানি, তিস্তা নয়। আপনার তিস্তা বিষয়ক সমস্যা সমাধানে যেকোনো বিকল্প প্রস্তাব বিবেচনা করতে আমি আগ্রহী।’
মমতার তড়পানো
মুখ্যমন্ত্রী যখন নিজেই ২০১১ সালে তিস্তার বিষয়ে সমীক্ষা পরিচালনায় কল্যাণ রুদ্রর নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করলেন, তখন সেটি বাংলাদেশের অনুকূলে গিয়েছিল। যদিও সমীক্ষাটি এখনো পর্র্যন্ত অপ্রকাশিত। বাংলাদেশের বিশিষ্ট পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, ‘শুকনো মৌসুমে গজলডোবা বাঁধের সবগুলো গেট বন্ধ করে দিয়ে আমাদের প্রান্তে ভারত সম্পূর্ণরূপে নদী শুকিয়ে ফেলছে। এটা একটি বন্ধু প্রতিবেশীর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত। এই চুক্তি একটি আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু ভারত নদীর পানিতে আমাদের অধিকার অগ্রাহ্য করতে পারে না।’
মমতা ব্যানার্জী তিস্তা ইস্যুর উপর বসে আছেন। এবং ছয় বছর ধরে তিনি তার গোলপোস্ট পরিবর্তন করছেন। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কারণ রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বল খেলা নাকচ করে চলেছে। এখন জল্পনা-কল্পনা প্রবল যে, মিজ ব্যানার্জী দিল্লি থেকে একটি ফিন্যান্সিয়াল প্যাকেজ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। আর সেই পথেই দরকষাকষির জন্য তিস্তা একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এর ফলে সাধারণ বাংলাদেশিদের এই অচলাবস্থার বোঝা বহন করতে হচ্ছে।
২০১৯ সালের গোড়ায় বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা তার নিজের দেশে সংকটে রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটি নবতর উচ্চতায় তুলতে তার ভূমিকা রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যখন অন্যান্য দিক থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ক্রমবিকাশমান এবং পরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ গলার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(১১ই এপ্রিলের দৈনিক দ্যা হিন্দুর সৌজন্যে)

পাঠকের মতামত: